নামাজ ভঙ্গের কারণসমূহ
ইসলামের মূল স্তম্ভ পাঁচটি, আর সেগুলো কালেমা, নামাজ, রোযা, হজ্জ ও যাকাত। একজন মুসলমান যদি এর কোনো একটি কে অস্বীকার করে তাহলে সে কাফিরে পরিনত হবে। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত এই বিষয় গুলো সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা।
নামাজে বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য যেমন কিছু শর্ত রয়েছে, তেমনিভাবে নষ্ট হওয়ার জন্যও কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। নিম্নোক্ত কারণ গুলোর জন্য নামাজ নষ্ট হয়ে যায়। কারণগুলো হলো :
১. নামাজে অশুদ্ধ পড়া : নামাজের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াতে যদি এমন ভুল বা অশুদ্ধ হয় যে ভুলের কারণে আয়াতের মর্মার্থ ওলট পালট হয়ে যায়, তবে নামাজ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
২. নামাজের ভিতর কথা বলা: নামাজে দাঁড়ানো ব্যাক্তি যদি নামাজের মধ্যে কথা বলে, তাহলে তার নামায নষ্ট হয়ে যাবে।
৩. নামাযের মধ্যে সালাম দেয়া : ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক নামাযের মধ্যে সালাম দেয়া নিষেধ। যদি কোনো ব্যক্তি নামাজে দাঁড়িয়ে সামাল দেয় তাহলে তার নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে।
৪. সালামের জবাব দেয়া : নামাযরত অবস্থায় কারো সালামের জবাব দিলে নামায ভঙ্গ হয়ে যাবে।
৫. দুঃখসূচক শব্দ উচ্চারণ করা : নামাযের মধ্যে কেউ দুঃখসূচক শব্দ যেমন-আহ, উহ, হায় ইত্যাদি ধরণের শব্দ উচ্চস্বরে করে নামায নষ্ট হয়ে যাবে।
৬. বিনা ওজরে কাশা : অর্থ্যাৎ কাশি না আসা সত্ত্বেও যদি কোনো ব্যক্তি কাশি দেয় বা কারো দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কাশি দেয় তাহলে নামাজ ভঙ্গ হয়ে যায়।
৭. আমলে কাসীর করা : নামাযের মধ্যে যদি কেউ আমলে কাসীর করে তবে নামায নষ্ট হয়ে যাবে। আমলে কাসীর হলো নামাযের মধ্যে এমন আমল করা যা দূর থেকে দেখলে মনে হয় যে, লোকটি নামায আদায় করছে না।
৮. বিপদে বা বেদনায় শব্দ করিয়া কাঁদা : নামাজরত অবস্থায় শব্দ করে কাঁদলে নামাজ ভঙ্গ হয়ে যায়।
৯. তিন তাসবিহ পরিমাণ সতর খুলিয়া থাকা: নাভির নিচ থেকে হাঁটু পর্যন্ত শরীরের কোনো স্থান যদি তিন তাসবিহ পরিমাণ সময় অনাবৃত থাকে, তাহলে তার নামাজ হবে না। তাই যদি কোনো ব্যক্তির গেঞ্জি, শার্ট বা প্যান্ট নাভির নিচ থেকে রুকু সিজদার সময় সরে গিয়ে তিন তাসবিহ পরিমাণ সময় এভাবে অতিবাহিত হয়, তাহলে তার নামাজ ভেঙে যাবে। (ফাতওয়ায়ে শামী ১/২৭৩, কাফি ১/২৩৮, মাওয়াহিবুল জলীল ১/৩৯৮, মুগনিল মুহতাজ ১/১৮৮, হাশিয়াতুত তাহতাবি ১/৩৩৭)
নারীদের মাথাও সতর। কোনো কারণে মাথার ওড়না সরে গেলে নামাজ ভেঙে যাবে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী ওড়না ছাড়া নামাজ আদায় করলে আল্লাহ তার নামাজ কবুল করেন না।’ (আবু দাউদ : ৬৪১, তিরমিজি : ৩৭৭, ইবনে মাজাহ : ৬৫৫)
১০. মুক্তাদি ছাড়া অন্য ব্যক্তির লোকমা (ভুল সংশোধন) লওয়া: যেমন ইমাম সাহেব কিরাতে ভুল করছেন, সঙ্গে সঙ্গে নামাজের বাইরের কোনো লোক লোকমা দিলে তা গ্রহণ করা। (ফাতাওয়ায়ে শামী ১/৬২২, ফাতাওয়ায়ে আলগীরী ১/৯৮)
১১. সুসংবাদ বা দুঃসংবাদে উত্তর দেওয়া: সুসংবাদ অথবা দুঃসংবাদের উত্তর দেওয়া দুনিয়াবি কথার শামিল, তাই এর দ্বারা নামাজ ভেঙে যায়। (ফাতাওয়ায়ে শামী ১/৬১৩, আল বাহরুর রায়েক ২/২)
১২. নাপাক জায়গায় সেজদা করা: নামাজের জায়গা পবিত্র হওয়া জরুরি। অর্থাৎ নামাজ পড়ার সময় নামাজি ব্যক্তির শরীর যেসব জায়গা স্পর্শ করে, সে জায়গাগুলো পবিত্র হওয়া, যা নামাজ শুদ্ধ হওয়ার জন্য অপরিহার্য শর্ত। তাই নাপাক বা অপবিত্র জায়গায় সেজদা করলে নামাজ ভেঙে যাবে। (বাদায়েউস সানায়ে ১/১১৫, আল বাহরুর রায়েক ২/৩৭, তাবয়ীনুল হাকায়েক ১/৯৫)
১৩. কিবলার দিক থেকে সিনা ঘুুরে যাওয়া: কোনো কারণে কিবলার দিক থেকে সিনা (বুক) ঘুরে গেলে নামাজ ভেঙে যায়। তবে যানবাহনে নামাজের ক্ষেত্রে মাসআলা ভিন্ন। (মারাকিল ফালাহ ১/১২১, নূরুল ঈজাহ ১/৬৮)
১৪. নামাজে কোরআন শরিফ দেখে পড়া: নামাজরত অবস্থায় কোরআন শরিফ দেখে দেখে পড়লে নামাজ ভেঙে যায়। (মারাকিল ফালাহ ১/১২৪, হাশিয়াতুত তাহতাবি ১/৩৩৬) তবে সৌদি আরবের আলেমরা এ মাসআলার ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করেন।
১৫. নামাজে শব্দ করে হাসা: নামাজে শব্দ করে অট্টহাসি দিলে ওজুসহ ভেঙে যায়। (কানযুদ্দাকায়েক ১/১৪০)
১৬. নামাজে সাংসারিক কোনো বিষয় প্রার্থনা করা: নামাজরত সাংসারিক/দুনিয়াবি কোনো দোয়া করলে হানাফি মাজহাব মতে নামাজ ভেঙে যায়। (ফাতাওয়ায়ে শামী ১/৬১৯, আল বাহরুর রায়েক ২/৩)। তবে এ মাসআলার ক্ষেত্রে অন্য মাজহাবের ভিন্নমত আছে।
১৭. হাঁচির উত্তর দেওয়া: নামাজের মধ্যে যদি কেউ অন্যের হাঁচি শুনে ইয়ারহামুকাল্লাহ' বলে হাঁচির জবাব দেয়, তবে তার নামায নষ্ট হয়ে যাবে।
(ফাতাওয়ায়ে শামী ২/১১৭)
১৮. নামাজে খাওয়া ও পান করা: নামাজরত অবস্থায় কিছু খেলে বা পান করলে নামাজ ভেঙে যায়। দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাবার নামাজরত অবস্থায় খেলেও নামাজ ভেঙে যাবে। (মারাকিল ফালাহ ১/১২১, নূরুল ঈজাহ ১/৬৮)
১৯. ইমামের আগে মুক্তাদি দাঁড়ানো: মুক্তাদির পায়ের গোড়ালি ইমামের আগে চলে গেলে নামাজ ভেঙে যাবে। তবে যদি (দুজনের জামাতে নামাজের ক্ষেত্রে) মুক্তাদি ইমামের পায়ের গোড়ালির পেছনেই দাঁড়ায়, কিন্তু তিনি লম্বা হওয়ার কারণে তাঁর সিজদা ইমাম সাহেবকে অতিক্রম করে যায়, তাহলে তাঁর নামাজের কোনো ক্ষতি হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ১/১৫৯, আল মাবসুত লিস সারাখসি ১/৪৩)
প্রসিদ্ধ এই ১৯টি ছাড়াও নামাজ ভঙ্গ হওয়ার আরো কারণ আছে। যেমন: কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী পাশে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়া, ইমামের আগে কোনো রোকন আদায় করে ফেলা, ইচ্ছাকৃত ওজু ভাঙার মতো কোনো কাজ করে ফেলা, পাগল, মাতাল কিংবা অচেতন হয়ে যাওয়া, নামাযের ফরয ছুটে যাওয়া, বাচ্চাকে দুধ পান করানো ইত্যাদি নামাজ ভঙ্গের কারণ।
No comments